নির্বাচনকে সামনে নিয়ে মিয়াপাড়া এলাকা বেশ সরগরম হয়ে ওঠেছে। একেক জনের মুখে একেক কথা। পরিসি’তি কিছু বোঝা যাচ্ছেনা। ক্ষমতার রশি কার হাতে যায় কে জানে!
আজকাল শহর বন্দর পার হয়ে পাড়াগ্রামেও নির্বাচন-রাজনীতির গরম হাওয়া পৌঁছে গেছে। এই এলাকায় রাজনীতিতে সবচেয়ে ’প্রভাবশালী’ মনে করা হয় হাওলাদার সাহেবকে। তছির উদ্দিন হাওলাদার। সাদা রঙের প্রাডো ল্যান্ড ক্রুজারে করে প্রত্যেক মাসের কোন না কোন শুক্রবারে আসেন গ্রামে। তবে ইদানিং নির্বাচনের কারণে ঘন ঘন আসছেন।গ্রামে দোতলা বাড়ি। শহরে ব্যবসা বাণিজ্য। মন্ত্রী টন্ত্রীর সাথে ওঠাবসা। গ্রামের কেউ কেউ বলাবলি করেন ‘তছির সাহেবের হাত অনেক লম্বা!চ কেউ কেউ ক্ষোভ নিয়ে আড়ালে বলেন ‘তার লম্বা হাত দিয়ে আমাদের কি! কোন্ দিন কার উপকারে লেগেছিল তার লম্বা হাত!
আজ শুক্রবার। তছির উদ্দিন হাওলাদার সাহেব এসেছেন গ্রামে। পাড়া পড়শি সবাই জুমা পড়তে মসজিদের সামনে সমবেত হয়েছেন। ঠিক সে সময় প্রাডো গাড়িটা মসজিদের সামনে খোলা জায়গায় পার্ক করা হয়েছে। পার্ক করার সময় গাড়ির ড্রাইভার অনর্থক একটা হর্ন দেয়। হর্ন শুনে সবাই একযোগে গাড়ির দিকে তাকায়।আশে পাশের শিশু কিশোরেরাও গাড়ির পাশে এসে ভিড় করে। দেখাদেখি করে। পাড়াগাঁয়ে এই ধরণের গাড়ি-ঘোড়া বিরল জিনিস। গাড়ি থেকে নামার সময় একটা আলাদা ’ভাব’ থাকে মালিকের। ব্যক্তিত্বকে ভারী করতে এই দৃশ্যটা সবার চক্ষুগোচর করা দরকার। গাড়ির দরজা খুলে আস্তে করে নামেন তছির উদ্দিন সাহেব। চোখে রোদচশমা। পরনে ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবি। ফর্সা গায়ের রং। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়সেও তরুণের মত মনে হচ্ছে তছির উদ্দিনকে। পেছনে হাত দিয়ে ধীর পায়ে মসজিদের সামনে আসেন তিনি। ততক্ষণে পেছনে পেছনে সাত আটজন জুটে যায়। এরা সম্ভবত চামচা।তাদের সাথে নিচু স্বরে মেপে মেপে কথা বলছেন তছির সাহেব। মেপে মেপে কথা বললে জ্ঞানীর মত লাগে। হাউকাউ করে কথা বলে অ-জ্ঞানীরা। ছেলে বুড়ো সবার সাথে কুশল বিনিময় করেন তছির সাহেব। তারপর সবার সাথে জুমা পড়ার জন্য মসজিদে ঢুকে যান।
জুমার শেষে দলে দলে বের হয় মুসল্লীগণ। নির্ঝঞ্ঝাট কেউ কেউ ঘরের দিকে পা বাড়ায়। উৎসাহী কেউ কেউ মাঠে সমবেত হয়। জটলা পাকায়। সামনে নির্বাচন। নানান মুখে নানান কথা শোনা যাবে। তাই ঘরে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি না করে জটলায় শরীক হয় কেউ কেউ। ছেলে বুড়োদের আলাদা আলাদা জটলা। আলোচনার প্রসঙ্গও আলাদা হয়। বুড়োদের জটলায় সত্তোরোর্ধ কচিমনের বাপ কাশতে কাশতে লট্টাশ করে একদলা কফ ফেলে মাটিতে। তারপর আবুল বিড়িতে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে কফ-কড়কড়ে গলায় বলেন ‘এইবার কেউরে ভুট দিতাম ন, সপ শালায় চুর। মিজানের বাপও সমর্থন করে বলে’ হ.. চুর চুর।
মাঠের অন্যপাশে যুবকদের জটলা। জটলার মাঝখানে তছির উদ্দিন হাওলাদার সাহেব। অনেক মূল্যবান, নীতি নির্ধারণী কথাবার্তা বলছেন। তার আওয়াজ জটলার বাইরে যাচ্ছেনা। সবাই হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে শুনছেন। হাওলাদার সাহেব মনোযোগের সাথে বলছেন- ‘শোন তোমরা, এবারের নির্বাচনটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে অনেক কথা বলবে সেদিকে কান দিয়ে লাভ নাই। কাজের কাজ করতে হবে তোমাদের। এবার আমাদের নেতা ক্ষমতায় গেলে এখানে রাস্তাঘাট সব পাকা হয়ে যাবে। স্কুল কলেজ দুটোই সরকারি হয়ে যাবে। তোমরা যারা যারা বেকার আছ একজনও বেকার থাকবেনা। এটা আমার মুখের কথা নয়। আমাকে খোদ মন্ত্রীসাহেব বলেছেন। মন্ত্রী সাহেব বলেছেন, তিনি মন্ত্রী হওয়া মানে আমি মন্ত্রী হওয়া। এখন ঘটনা বোঝো! সুতরাং এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে যেভাবে হোক তাকে জিতিয়ে দেয়া।
কি! পারবে তো সবাই?’
জটলা থেকে সমস্বরে আওয়াজ হল- ’পারব ইনশাল্লাহ।’
জটলা থেকে একটু দূরে বাদাম গাছ তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে তছির উদ্দিনের কথা শুনছে নাইমুল। স্যান্ডেল থেকে পা খুলে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে কি যেন দাগ কাটছে সে। কানটা পড়ে আছে তছির উদ্দিনের বক্তব্যে।
তার মুখে একদলা থুথু জমা হয়েছে। ওয়াক থু’ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন’’ ফেলছেনা। একপাশে গিয়ে নিঃশব্দে থুথু ফেলে সে। তছির উদ্দিন প্রত্যেকবারই এই ধরনের কথা বলে। তার দল জেতেও। কিন’ জেতার পর আর দেখা পাওয়া যায়না তাদের। তছির উদ্দিনের এমন আশ্বাস আর প্রলোভন সর্বস্ব বক্তব্য শুনে সে মনে মনে হাসে। এদেশের নেতা-রাজনীতির ব্যাপার স্যাপার তার কাছে কেমন যেন উল্টো উল্টো লাগে। প্রকৃত নেতা সম্পর্কে তার ভেতরে একটা চিত্র আঁকা আছে। সেটার সাথে এদেশের নেতাদের কোনরকমে মিলে না। তার ধারণা, কোন মামুলি মানুষের পক্ষে নেতা হওয়া সম্ভব না! নেতা হবেন একজন অসাধারণ মানুষ। যার পেছনে থাকবে একটা অঞ্চল কিংবা জাতি, গোষ্ঠী। যে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাবে তার অঞ্চলের ভুখা নাংগা মানুষ, অবহেলিত জনপদ, ভাঙাচোরা অবকাঠামো। তিনি অনর্থক হাসবেন না। তিনি হাসবেন- ভুখা, নাংগা মানুষের হাসির পরেই।
কিন’ এটা একধরণের বিলাসী ভাবনা। একজন বেকার যুবকের এই সমস্ত উদ্ভট ভাবনা দিয়ে দেশ চলে না- এটা মনে পড়ার সাথে সাথে লজ্জিত হয় নাইমুল।
হঠাৎ সে খেয়াল করে তছির উদ্দিন সাহেব তার দিকেই আসছেন। সে ভাবনা টাবনা বাদ দিয়ে একটু মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করে। তছির উদ্দিন কাছে এসে বললেন- ‘নাইমুল কেমন আছ?’
নাইমুল যথাসম্ভব বিনয়ের সাথে বলল- ‘ভাল আছি ভাইয়া’
‘তোমার পড়ালেখার কি খবর?’
‘জ্বি,ভাইয়া, মাস্টার্সটা দিলাম কিছুদিন আগে।’
‘চাকরি টাকরির হল কোন কিছু?’
‘না, ভাইয়া। এখনও হয়নি কিছু।’
তছির উদ্দিন বিজ্ঞের মত ভাব নিয়ে বলল-’কি মনে কর? চাকরি কি আর এমনে এমনে হয়! লাইন লাগে, লাইন! আচ্ছা এক কাজ করবে, তোমার সার্টিফিকেট এর কপি টপি সব আমাকে দিও। আমি লাগিয়ে দেব কোন খানে।’
নাইমুল হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে চুপ করে রইল। মনে হচ্ছে তার নুয়ে যাওয়ার পুরোটাই অক্ষমতার লজ্জা।
তছির উদ্দিন নাইমুলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল -’চলো আমাদের সাথে একটু জনসংযোগে।’
পাড়ায় পাড়ায় পার্টির পক্ষে জনসংযোগ হবে আজ। নেতৃত্ব দেবেন তছির উদ্দিন।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও নাইমুল তাদের সাথে চলতে শুরু করে। হয়ত ’না’ বলার সাহস হয়না।
সামনে তছির উদ্দিন। পেছনে দশবারো জন যুবকের সাথে চলতে চলতে নাইমুল ভাবে, এদিক ওদিক না তাকিয়ে শুধু শুধু পড়াশোনা নিয়ে দিন কাটিয়ে তেমন লাভের লাভ কিচ্ছু হয়নি। একটু পার্টি টার্টি করলে আজকে কত সুন্দর চাকরি সে করতে পারত। ক্লাসের পেছনের টুলের অনেকেই এই সূত্রানুসারে পার পেয়ে গেছে। আটকে গেছে শুধু সে-ই।
তছির উদ্দিন সাথের যুবকদের নিয়ে প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে গেল। সবার সাথে কথা বলল। কুশল বিনিময় করল। হেসে হেসে মিষ্টি করে কথা বলল। প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে সেই একই কথা। দাঁড়ি কমাও পরিবর্তন হয়না। মনে হয় মুখস’ করে ফেলেছে। মুখস’ বিদ্যার ছাত্ররা দাঁড়িকমাও ভুল করে না। ‘মন্ত্রী বলেছে, এইবার ক্ষমতায় গেলে এইখানে কোন সমস্যাই আর সমস্যা থাকবেনা। রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, চাকরি, বাকরি সব সমস্যার একদম সমাধান। মন্ত্রী এও বলেছে- তিনি মন্ত্রী হওয়া মানে আমিই মন্ত্রী। তাহলে আপনাদের ছেলে মন্ত্রী হোক সেটা কি আপনারা চান না!চ
গরিব, অভাবী, সহজ সরল পাড়াপড়শিরা তার কথা সহজেই বিশ্বাস করেন। তারাও মাথা নেড়ে সায় দেন- ’ হ..বাজান।’
তছিরউদ্দিন বড় মানুষ। তার মত এরকম বড় মানুষের পা’ তাদের দরজায়- লজ্জা সংকোচে একেবারে মিইয়ে যায় পাড়া প্রতিবেশী।
এলাকার ছেলে তছির উদ্দিন। এলাকার মানে নিজের ছেলে। নিজের ছেলে মন্ত্রী হলে আর কি! বিপদে আপদে পাওয়া যাবে সবসময়।
মুরুব্বীরা তছির উদ্দিনের গায়ে হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে বলে- ‘বাবা, তুমি যেদিকে যাইবা, আমরাও সেইদিকে যাইব। আমরা কি তোমারে কখনো পিছ দিতে পারি!’
জনসংযোগ শেষ হতে ঘণ্টা দু’য়েক লেগে গেল।
তছির উদ্দিন চলে যাবেন। যাবার আগে প্রাডোর পাশে দাঁড়িয়ে কর্মীদের উদ্দেশ্যে ঠিকঠাক মত কাজ করার পরামর্শ দিলেন। নাইমুলের সাথেও কথা বললেন। ‘চিন্তা করনা তোমার একটা ভাল চাকরি হয়ে যাবে’- বলে হ্যান্ডশেক করে গাড়িতে ওঠে গেলেন।
নাইমুল খেয়াল করল হ্যান্ডশেক করার সময় তার হাতের মুঠোর ভেতর কাগজের মত কিছু একটা গুঁজে দিয়েছেন তছির উদ্দিন। নাইমুল মুঠো না খুলেই বন্ধ করে রাখে।
সবাই আস্তে আস্তে যার যার গন্তব্যে পা বাড়াল। নাইমুলও বাড়ির দিকে পথ ধরল। একটু নির্জন দেখে, আগে পিছে তাকিয়ে সে দাঁড়াল। হাতের মুঠো খুলে দেখল সে। ভাঁজ করা কচকচে একটা একশ টাকার নোট!
উল্টে পাল্টে দেখে সে। একদিকে বঙ্গবন্ধুর ছবি। অন্যদিকে একটা মসজিদের ছবি। তারা মসজিদ, ঢাকা।
ভ্রূ কুঁচকে ভাবনার ডালপালা মেলে নাইমুলের। কেন দিয়েছে এই একশ’ টাকা! ভাড়া! তছির উদ্দিন কি ভাড়া করেছিল তাকে! ভাড়াটে! বেকার,অসহায়- এটাই কি সুযোগ! ক্ষোভে, অক্ষমতায় তার শরীর কাঁপতে চায়।
খুবই ঘেন্না লাগে নিজেকে!
তছির উদ্দিনদেরকে ভালোভাবে চেনে সে। এরা দু’চার পয়সা খরচ করে মানুষকে ভাড়া খাটায়। স্বার্থ হাসিল করে নেয়।
এদেশে এখন অনেক কিছু ভাড়ায় পাওয়া যায়। ভাড়ার হার ক্ষেত্র বিশেষে চড়াও হয়। লাশের পাশে বসে কান্না করার জন্য ভাড়ায় মানুষ পাওয়া যায়। দুই তিন ঘণ্টার জন্য কর্মী পাওয়া যায়। বড় বড় নেতা পাওয়া যায়। এমনকি দলও পাওয়া যায়। নারী পাওয়া যায়।পুরুষ পাওয়া যায়। মানুষের নামে নামে মৃত্যু পাওয়া যায়। সুখ পাওয়া যায়। আরো অনেক কিছু…।
মুখে একদলা থুথু জমা হয় নাইমুলের। ওয়াক থু’ করে রাস্তার পাশে থুথু ফেলে সে।টাকাটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। কিন’ সে ছিঁড়লনা। টাকাটা অনেকের হাতে হাতে ঘুরবে। ঘুরুক। দলামোচা টাকাটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে সে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন