বৈশাখ চিরদিনই রুদ্র। বৈশাখের রুদ্র রূপ প্রকাশিত হয়েছে মধ্যযুগের সাহিত্যেও। পহেলা বৈশাখ পুরনো বিদীর্ণ খোলসকে বাদ দিয়ে অগ্রগামী হওয়ার দুর্বার ইচ্ছা নববর্ষকে বরণের বিপুল উদ্দীপনার মধ্যে নিজের সংস্কৃতির প্রতি বিনম্র ভালোবাসা প্রকাশিত হয়।
বাংলা সনের প্রথমদিন পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ। এই পহেলা বৈশাখ বাক্যটাতে আমার গুরুতর আপত্তি রয়েছে। যেমন রয়েছে, ১লা ( পহেলা) জানুয়ারি, ২রা (দুসরা) ফেব্রুয়ারি, ৩রা (তিসরা) মার্চ ইত্যাদি বাক্য বা শব্দ ক’টিতে। পহেলা, দুসরা, তিসরা ও চৌঠা (চৌথা) এই শব্দগুলি বাংলা নয়। পাকিস্তান আমলে এই উর্দু-ফার্সি শব্দগুলি ব্যবহৃত হতো উর্দু- বাংলার সংমিশ্রণে। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরও কেন আমরা আজও ১ম (প্রথম) বৈশাখ, ২য় জানুয়ারি, ৩য় মার্চ বলতে পারছি না?
শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা সর্বত্র বাংলা চালুর কথা বলে থাকি। ষোল আনা বাঙালি শুধু পান্তা ইলিশ খেলে হওয়া যায় না। এই পান্তা ইলিশ খাওয়া বাংলা নববর্ষের কোন ঐতিহ্য নয়। যারা বর্ষবরণে পান্তা ইলিশ খাওয়ার প্রচলন করেছে তারা একদিকে বাঙালির চিরাচরিত ঐতিহ্যকে ধ্বংস করছে অন্যদিকে জাটকা নিধন করে আমাদের জাতীয় মৎস্য ইলিশকে নিশ্চিহ্ন করার মতো ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। তাই নববর্ষে ইলিশ বর্জন করুন। যারা নববর্ষে ইলিশ ভোজন করেন তারা ষোলআনা বাঙালি হতে পারে না।
বাংলা নববর্ষে আসুন, আমরা শপথ করি বাংলাকে বাংলার মতোই বলবো। বাংলাকে বাংলার মতই লিখবো। হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারোমাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরিয় পঞ্জিকার এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথমদিন বাংলা শুভ নববর্ষ। আসাম, বঙ্গ, কেরালা, মণিপুর, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাডু ও নেপাল এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এটি অনেক আগে থেকেই পালিত হত।
সুতরাং বাংলা নববর্ষ আমাদের উপমহাদেশে একটি সার্বজনীন সামাজিক উৎসব। এই উৎসবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকে। এটা হিন্দু বা মুসলমান সম্প্রদায়ের একক অনুষ্ঠান নয় খৃষ্টান কিংবা বৌদ্ধের একক অনুষ্ঠান। এটা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির অনুষ্ঠান। যার যেভাবে খুশি এই অনুষ্ঠান উদযাপন করবে। এখানে অহেতুক ধর্মকে টেনে এনে জলঘোলা করা কারোরই উচিত নয়। তবে কুসংস্কার যেন এই আনন্দঘন অনুষ্ঠানকে স্পর্শ করতে না পারে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা অতীব প্রয়োজন।
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নববর্ষ নিয়ে মানুষের মাঝে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে। যদিও এই সব ধারণার বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। তারপরও এই সব অযৌক্তিক ভ্রান্ত ধারণাসমূহ মানুষ মেনে আসছে যুগ যুগ ধরে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালনের রীতিনীতিও কিন্তু এক নয়। কিছু কিছু মিল থাকলেও নববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ হয় দেশীয় ঐতিহ্য। নববর্ষের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে বর্ষবরণ করা হয়। এগুলোর মাঝে কিছু চমকপ্রদ মজার প্রথা প্রচলিত আছে। এবার তা কিঞ্চিৎ আলোচনা করবো। যেমন থাইল্যান্ডের লোকেরা একজন আরেকজনের গায়ে পানি ছিটিয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। মেক্সিকোর অধিবাসীরা রাত বারোটার সঙ্গে সঙ্গে বারোবার ঘন্টা বাজায়। এ সময় প্রতি ঘন্টাধ্বনির সঙ্গে একটি করে আঙ্গুর খায়। এবং তারা বিশ্বাস করে এই সময় যা কামনা করা হয়, তাইই পূরণ হয়।
কোরিয়াতে নববর্ষ উদযাপনের সময় কেউই ঘুমায় না। তাদের বিশ্বাস, এই সময় ঘুমালে নাকি চোখের ভ্রূ সাদা হয়ে যায়। রাত বারোটার সঙ্গে সঙ্গে টিভিতে তেত্রিশবার ঘণ্টা বাজানো হয় কোরিয়ার তেত্রিশ বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। নববর্ষের সুপ্রভাতে কোরিয়ানরা প্রায় সবাই সূর্যোদয় দেখে, এবং সুর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়।
ব্রাজিলিয়ানরা রিওডি জেনিরোর সমুদ্রসৈকতে নববর্ষের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানটি করে থাকে। এর অন্যতম আকর্ষণ চোখধাঁধানো আতশবাজি প্রদর্শনী। এদিন অধিকাংশ লোকই সাদা পোশাক পরিধান করে থাকে। তাদের বিশ্বাস সমুদ্রে সাতটি ডুব দিলে এবং সাতটি ফুল ছুঁড়ে দিলে বছরটি খুব ভালো কাটবে।
আর্জেন্টিয়ানরা নববর্ষের আগের দিন রাত্রে পরিবারের সকল সদস্য একসঙ্গে আহার করে। তারপর বড়রা নাচের অনুষ্ঠানে চলে যায়। ভোর পর্যন্ত চলে এই নাচের অনুষ্ঠান। নববর্ষের প্রথমদিন নদী বা পুকুরে সাঁতার কেটে তারা নববর্ষ উদযাপন করে।
আমরা নববর্ষ উদযাপন করি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে। যেমন মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা করে। গান বাজনা, নানা সাজে সজ্জিত, নানা রঙে বর্ণিল পোস্টার ব্যানার এবং পান্তা ইলিশ খেয়ে। যাদের ইচ্ছা হবেনা তারা মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালাবে না, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করবে না, এক্ষেত্রে কেউ কাউকে তো বাধ্য করছে না। সেটা প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এটার বিরোধিতা করা সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয়। আমি আগেই বলেছি, বাংলা নববর্ষ কোন ধর্মীয় উৎসব নয়। এটি বাঙালি জাতির কৃষ্টি সভ্যতা ও ঐতিহ্যের মেলা।
ঐতিহাসিক সত্য হল, চতুর্দশ শতকের প্রথমদিকে মোগল সম্রাট আকবর এর সময় থেকেই রাজস্ব আদায় উপলক্ষে বাংলা নববর্ষ দিবসটি বাংলা সন গণনায় শুরু হয়। যখন বাংলা সন প্রথম চালু হয়, এতদ অঞ্চল তখনো বাংলা বা ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত ছিল না। অভিহিত ছিল বঙ্গ বা পুণ্ড্র নামে। মোগল শাসকদের আমলেই পূর্ববঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের উপকূলীয় বিভাগ এক ঐক্যবদ্ধ শাসনের অধীনে শাসিত হয়। বাংলা সনের উৎপত্তি তখন থেকেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সম্রাট হোসেন শাহ্? এর আমল থেকেই বাংলা ভাষা তাঁর রাজদরবারে প্রথম স্থান পায়। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাভাষার চর্চা, ভাষাগত ঐক্য ও জাতীয় সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের নববর্ষের উৎসবের দিনটি গ্রাম বাংলায় ‘পরব’ (পার্বণ) হিসেবে পালিত হয়। আর এই পার্বণ অর্থ আনন্দ উৎসব। সুতরাং আনন্দ উৎসবে আনন্দ প্রকাশ করা কোনকালে কোন ধর্মে নিষেধ ছিলনা, এখনো নেই। তবে আনন্দ প্রকাশ যেন অবশ্যই শালীনতা বিবর্জিত না হয়। কোন ধর্মকে যেন কটাক্ষ করা না হয়। কারো ধর্মীয় অনুভুতিতে যেন আঘাত দেয়া না হয়। যাকে বলে নির্মল আনন্দ।
বিদেশি সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে যতই প্রভাব বিস্তার করুক না কেন, দেশজ সংস্কৃতি মিশে আছে রক্তধারার সাথে। নববর্ষ শব্দটার সাথে মিশে আছে নতুনত্ত্বের আমেজ। নানাদিক থেকে দিনটিকে বাঙালির জীবনে একটি আলাদা দিনে পরিণত করেছে। তাই পয়লা বৈশাখ এই বাংলার হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান সব ধর্মের বাঙালিদের উৎসবের দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন