রাত ১০ টা ২৫ মিনিট । টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম । মিরপুর
দশ নম্বর পার হয়ে মিরপুর তের নম্বরের রাস্তায় হাঁটছি । লাজ ফার্মার সামনে আসতেই
আমার পা আটকে গেলো । ফুটপাতের এক পাশে কয়েকজন ভীর করে রেখেছে। কৌতূহলের বশে দেখার
চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে সেখানে । এগারো বারো বছরের একটা ছেলে বসে আছে । তার সামনে
একটা ওজন মাপার যন্ত্র । তাতে লেখা “ওজন মাপুন ২ টাকা দিয়ে” । ছেলেটার এক পাশে
একটা স্কুল ব্যাগে কিছু বই গাইড । তার হাতেও একটা গাইড । সে মন দিয়ে পড়ছে । রাস্তার
মৃদু আলোয় গাইডের লেখাগুলো আবছা লাগছে । ঠিকমতো দেখাও যাচ্ছেনা । তবুও ছেলেটার চোখ
পড়ার মধ্যে । শুধু ওজন মাপার পর টাকা নিয়ে আবার পড়ায় মন দিচ্ছে । আগের রাতে বৃষ্টি
হওয়ায় সারাটা দিন ছিল থমথমে । সাথে ঠাণ্ডা বাতাস । রাতেও আরও ঠাণ্ডা । এই ঠাণ্ডার
মধ্যে ছেলেটার গায়ে শুধু একটা শার্ট । তার এক হাত শার্টের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছে ।
যেন ঠাণ্ডা না লাগে । মাঝে মাঝে কাঁপছেও । হঠাৎ মনে হলো অনেক দিন তো নিজের ওজন
মাপা হয়না । নিজের ওজন মাপাও যাবে র সাথে ছেলেটাকে সাহায্য করা যাবে । ছেলেটাতো
এমনি এমনি টাকা চাচ্ছে না । আমার আগে হয়তো অনেকেই এই ভেবেই ওজন মাপিয়েছে । আর কেউ
হয়তো দুই টাকার বেশি দিয়েছে । ভাবতে ভাবতেই ওজন মাপালাম ।
দেখলাম যন্ত্রটার পিছনেই
ছেলেটার ছবিসহ হাতে লেখা পরিচয়পত্র । হালকা আলোয় স্পষ্ট কিছু বুঝা যাচ্ছিলনা । তাই
ছেলেটার সাথেই কিছু কথা বললাম । তোমার নাম কি ? ছেলেটা ওজন মাপার টাকা নিতে নিতেই
উত্তর দিল ।
-
শুভ ।
-
গ্রামের বাড়ি
কোথায় ?
-
পটুয়াখালী ।
আরও একজন ওজন মাপিয়ে দুই টাকার পরিবর্তে পাঁচ টাকার একটা
কয়েন দিল । ছেলেটা অনেক খুশি হলো । টাকাটা রেখেই আবার পড়ছে ।
-
কোন ক্লাসে পড়
তুমি ?
-
পঞ্চম শ্রেণিতে
পড়ি ।
হঠাৎ পিছন থেকে এক লোক আমাকে প্রশ্ন করলো – ভাই, ওটা কি ?
আমি বললাম ওজন মাপার যন্ত্র । লোকটি অনেক অবাক হলো । মনে হলো প্রথম দেখেছে । আমি
আবারো ছেলেটার দিকে মন দিলাম । কোন স্কুলে পড় ?
-
কাজীপাড়া
প্রাথমিক বিদ্যালয় ।
-
ক্লাসে তোমার রোল
কতো ?
-
পাঁচ ।
-
এই আলোয় অক্ষর
দেখা যাচ্ছে ? বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না ?
-
না । সমস্যা
হয়না । আমি প্রত্যেক রাতেই এখানে পড়ি ।
প্রায় দশ মিনিট কথা বললাম । এর মাঝে অনেকেই এসে ওজন মাপালো
। কেউ দুই টাকা দিলনা । কথায় কথায় জানতে পারলাম ছেলেটার বাবা নেই । অনেক ছোট
থাকতেই ছেলেটার বাবা মারা গেছে । মা গার্মেন্টসে চাকরি করে । কোন ভাই বোন নেই ।
বাসা পাশেই একটা গলিতে ।
ঢাকা শহরে এমন
অনেক ছেলে মেয়ে আছে যারা অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করে । এরা কারো কাছে হাত পেতে টাকা
চাচ্ছে না । কাজ করে টাকা উপার্জন করে পড়ছে । কারো হাত নেই, পা নেই । কারো আবার
চোখও নেই । তবুও তারা কারো কাছে হাত পাতে না । সমাজের চোখে চোখ রাঙিয়ে এরা নিজ
পরিশ্রমে জীবনযাপন করছে । তাই এই সব মানুষকে অবহেলা না করে তাদের পাশে দাঁড়ানো
উচিত । আমরা তো অনেক সেবা নেই । এদের দেয়া সেবাটাও না হয় নিলাম । এতে এই মানুষগুলো
আরও সুন্দর স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচার সুযোগ পাবে । এই সব মানুষগুলোর প্রতি রইল আমার
অনেক অনেক সম্মান ও শ্রদ্ধা ।
লেখক - আমিনুল ইসলাম
আকাশ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন